নিজস্ব প্রতিবেদক : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে, যখন (দলটির) যারা হত্যা ও ক্ষমতার অপব্যহারের সাথে জড়িত, তাদের বিচার সম্পন্ন হবে। অন্যরা নির্বাচনে অংশ নিতে যতটা স্বাধীন, তারাও ততটাই স্বাধীন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গনে লড়াই করব।’’

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

টাইমের প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন; ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন; সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন; মানবাধিকার; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

ড. ইউনূস টাইম ম্যাগাজিনকে জানান, শেখ হাসিনার পতনের পর যখন তাকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়, তখন প্রথমে তিনি নিতে চাননি। তবে গণঅভ্যুত্থানে নিহত মানুষ ও তাদের পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রধান উপদেষ্টার শপথ নেন তিনি। 

তিনি বলেন, “প্রথমে, আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি বলেছি, অন্য কাউকে খুঁজে বের করুন। কিন্তু পরবর্তীতে বলেছি, ঠিক আছে, আপনারা জীবন দিয়েছেন, আপনাদের বন্ধুরা জীবন দিয়েছেন; তাহলে আমি আমার সেরাটা চেষ্টা করব।”

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে তার কথা বলার বিষয়টি ‘নিজের অভিমত’ বলে টাইম ম্যাগাজিনকে জানিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। 

তিনি বলেন, “তাকে শুধু ভারত আশ্রয়ই দেয়নি। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, তিনি সেখান থেকে কথা বলছেন। যা আমাদের জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে। তার কণ্ঠ শুনলেই মানুষ অখুশি হয়। অর্থাৎ, এই বিষয়টি আমাদের বন্ধ করতে হবে।”

সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হবে নাকি সংসদীয় ব্যবস্থা থাকবে, সংসদ এককক্ষ বিশিষ্ট থাকবে নাকি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, সেগুলো এখনো নির্ধারিত হয়নি। সংবিধান সংস্কারের বৈধতার জন্য গণভোটের প্রয়োজন রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তবে এই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান কোনো রাজনীতিককে যুক্ত করা হয়নি।

নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়টি অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘‘তবে এই সংস্কারের জন্য মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা দরকার। যদি জীবনমান উন্নয়ন না হয় তাহলে মানুষ ধৈর্য্যহারা হয়ে যেতে পারেন। এমনকি বলতে পারেন, আওয়ামী লীগের সময়ই ভালো ছিল। এই পুরো অভ্যুত্থানের মূল হলো ‘সংস্কার’। এ কারণেই আমরা এটিকে বলছি বাংলাদেশ ২.০।”

এ বিষয়ে বিএনপির তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই তারা ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এটা ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের’ ইঙ্গিত দেয়।’’

যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা ও রূপরেখা চান বিএনপি নেতা ওয়াহিদুজ্জামান। তবে এ নিয়ে তাড়াহুড়া করতে চান না প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ভাষ্যমতে, ‘‘নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো নির্ধারণ করেনি সরকার। প্রথমে আমাদের রেললাইন ঠিক করতে হবে, যাতে ট্রেন সঠিক দিকে যেতে পারে।’’

টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ বড় করে তুলে ধরতেন, তারা এখন দলটির সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে আনছেন। ভয় পাচ্ছেন যে এই সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের ওপর চড়াও হতে পারেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে শেখ হাসিনার প্রতি সহানুভূতিশীল সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং অন্তত ২৫ জনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সহিংসতার মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড অ্যাসিসট্যান্স–বিষয়ক পরিচালক অ্যান্টনি বার্নার্ড বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। এই অনৈতিক প্রক্রিয়া বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী সবকিছু করতে হবে।’’

সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের ‘সম্পর্কের’ বিষয়টিও উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ড. ইউনূসের সঙ্গে ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব’ আছে।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সাক্ষাতে দুই নেতার মধ্যে আন্তরিকতার প্রসঙ্গ টেনে টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর যে বিচ্ছিন্ন হামলা হয়েছিল, তা আরও বড় করে দেখাতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে কট্টর ইসলামপন্থীরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছে দলটি।

৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানান ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’’

এখন আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী মার্কিনরা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে ট্রাম্পের কাছে তদবির করছেন বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া ডেমোক্র্যাট নেতা হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ড. ইউনূসের বন্ধুত্ব রয়েছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন হিলারি। তারপর ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘‘ট্রাম্পের জয় আমাদের এতটা আঘাত দিয়েছে যে আজ সকালে আমার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।’’

তবে ড. ইউনূস আত্মবিশ্বাসী যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরও ট্রাম্পের সঙ্গে একটি অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে পারবেন। ড. ইউনূসের ভাষায়, ‘‘ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী; আমরা ব্যবসার মধ্যে রয়েছি। কোনো সংকট থেকে বের হতে সহায়তার জন্য আমরা অর্থ চাচ্ছি না। আমরা একটি ব্যবসায়ী অংশীদার চাই।’’

টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বাদে সত্যিকার জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব না–ও হতে পারে। অন্তত একটা সময় দলটির বিপুল জনসমর্থন ছিল। বর্তমানে দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলছেন, তারা কোনো বাছবিচার ছাড়াই নির্বিচার আক্রান্ত হচ্ছেন।

গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন জাহিদ মালেক। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি টাইমকে জানান, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করছেন না। কারণ, তিনি হৃদ্‌রোগে ভুগছেন এবং মনে করছেন যে তাকে জামিন দেওয়া হবে না। জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘আমার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। আমার পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। আমি অসুস্থ। চার মাস ধরে আমি পরিবারের সদস্যদের দেখি না।’’

‘আওয়ামী সরকারের’ আমলে যেসব অর্থ পাচার হয়েছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেসব দেশকেই আমরা পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি, তারা সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”